দেবী সরস্বতী একমাত্র হিন্দু দেবী যিনি হিন্দু ঋষি দ্বারা সৃষ্ট হলেও বৌদ্ধ ও জৈন সম্প্রদায়ের কাছেও তিনি পূজিতা। বিভিন্ন বৌদ্ধবিহারের উপাসনালয়ে দেবী সরস্বতীর মূর্তি পাওয়া যায়। মথুরায় জৈনদের প্রাচীন নিদর্শনেও দেবী সরস্বতীর মূর্তি পাওয়া গেছে।
জাপান, তিব্বত প্রভৃতি দেশের বুদ্ধ গুম্ফাতেও কয়েক হাজার বছর ধরে পূজিত হচ্ছেন দেবী সরস্বতী। বহু প্রাচীনকালে ঋকবেদে ব্রহ্ম জ্ঞানের স্বরূপ রূপে দেবী সরস্বতীর সৃষ্টি করা হয় যিনি ঈশ্বরের বাকশক্তির প্রতীক ছিলেন। সামবেদে দেবী হস্তে অর্পণ করা হয় বেদকে। বহু প্রাচীনকাল থেকেই দেবী সরস্বতীর আরাধনা ভারতবর্ষ তথা বিদেশেও হয়ে আসছে।
কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার পুরনো কলকাতায় মা সরস্বতীর আরাধনা কিন্তু পাড়ার ক্লাবগুলিতে কিংবা বনেদি বাড়ির গৃহতে করা হতো না। পুরনো কলকাতায় হাতেগোনা কয়েকটি গৃহস্থবাড়িতে হয়তো এই পূজা হতো। আসলে বাবু সংস্কৃতির পুরনো কলকাতায় দেবী সরস্বতীর আরাধনা হত কলকাতার নিষিদ্ধ পল্লীতে।
কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতুম প্যাঁচা’র নকশা থেকে জানা যায় সরস্বতী পুজোর কয়েকদিন আগে থেকেই বেশ্যা গৃহগুলি আনন্দ-উৎসবে মেতে উঠতো। যেখানে নাচ-গান এমনকি যাত্রাপালার আয়োজন চলত। ঘোড়ায় টানা গাড়িতে করে হুড়োহুড়ি পড়ে যেত বাবুদের এই নিষিদ্ধ পল্লীতে। সরস্বতী পুজোয় কল্পতরুর ন্যায় মুক্তহস্তে দান করতেন এই বাবুরা । এই দানের মাধ্যমেই তাদের আভিজাত্যের অহংকার ফুঁটিয়ে তুলতেন। কলকাতার উল্লেখযোগ্য নিষিদ্ধপল্লিগুলিতে বাবুদের অতিথিরা এমনকি পরিচারক- পরিচারিকারাও ভিড় জমাতেন।
সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন-“যিনি উৎসবার্থে দুর্গাপূজা করিবেন, গৃহিণীর অনুরোধে লক্ষ্মীপূজা করিবেন এবং উপগৃহিণীর অনুরোধে সরস্বতী পূজা করিবেন এবং পাঠার লোভে গঙ্গাপূজা করিবেন, তিনিই বাবু।” অর্থাৎ এই বাবুরা সেইসময় নিষিদ্ধপল্লির কুঠুরিতে উৎসবের সাথে সরস্বতী পূজা করতেন।
১২৮৬ বঙ্গাব্দে ‘আর্যদর্শন’ পত্রিকাও এই নিষিদ্ধপল্লির সরস্বতী পূজার বর্ণনা দিয়েছে। সেই সময় সরস্বতী পুজোর আগের দিন কোন কুমারী মেয়ের কৈমার্য্য হরনের জন্য বাবুরা নিলাম করে উৎসব পালন করতেন।
পুরনো কলকাতায় বাবুদের ধারণা ছিল যে বিদ্যার দেবী আসলে কামসূত্রের চৌষট্টি কলার আরাধ্যা। তাই তার পূজা নিষিদ্ধপল্লীতে করাই বাঞ্ছনীয়। তবে ১৮২৬ সালের ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকা কলকাতায় কয়েকটি বনেদি বাড়ি যেমন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কৃষ্ণকান্ত দত্ত প্রমুখ এর বাড়িতে সরস্বতী পূজা হতো সেই তথ্য দিচ্ছে।
সম্ভবত ১৮৫৯ সালের পর থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ক্রমে ক্রমে সরস্বতীর বন্দনা শুরু হয়। এরপর পাঠশালা এবং বিদ্যালয়ে সরস্বতী পূজায় প্রচলন ঘটতে থাকে। এই পূজায় উৎসাহ দিয়েছেন পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়, তিনি শিশুদের মধ্যে লুচিও মিষ্টান্ন বিতরণও করেছিলেন।
এরপর রামচাঁদ শীল, বি.কে পাল মহাশয় এর বাড়িতেও ধুমধাম করে সরস্বতী পুজো পালিত হয়,এবং প্রতিষ্ঠিত হয় সরস্বতীর মূর্তি। এরপর থেকেই ধীরে ধীরে সরস্বতী পূজা সার্বজনীন পূজার রূপ নেয়।
বাংলার মন্দির ও শিল্পের ইতিহাস।।
সুরথ চক্রবর্তী।।