দলগাও ( আলিপুরদুয়ার) ঃ বগটুই নারকীয় হত্যাকান্ডের ঘটনা দীর্ঘ ১৯ বছর পর উত্তরবংগের জনমানসের মনে মাটি খুড়ে তৎতকালীন জলপাইগুড়ি জেলা অধুনা আলিপুরদুয়ার জেলার বীরপাড়া এলাকার দলগাও চা বাগানের ১৯ জনের জীবন্ত পুড়িয়ে মারার স্মৃতিকে উসকে সামনে নিয়ে এসেছে। যা সেই সময় শুধু পশ্চিম বংগে নয় সারা দেশে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল। সেদিনের সেই বিভ্যসতম হত্যালীলার আগুনে রুটি সেকতে ছুটে এসেছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা নেত্রীরা। ছুটে এসেছিলেন এখন যিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তিনিও। কিন্তু তাকে আটকে দেওয়া হয়েছিল ঘটনাস্থল থেকে অনেক দুরেই। যথারীতি সে সময় বামেদের দখলে থাকা এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টচার্য্য আজকের মুখ্যমন্ত্রীর মত বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছিলেন ” ঘটনা দুখজনক তবে এর সাথে রাজনীতির কোন সম্পর্ক নেই। সি পি এম এর রাজ্য সম্পাদক প্রয়াত অনিল বিশ্বাস ও মুখ্যমন্ত্রীর সুরে সুর মিলিয়ে বলেছিলেন এইএক কথার পাশাপাশি বলেছিলেন সেখানে বেশ কিছু দিন ধরে অসমাজিক কাজকর্ম জুয়া মদের আসর চলা নিয়ে স্থানিওদের ক্ষোভের কারনে ঘটেছে।সে সময়ে রাজ্য কংগ্রেসের সভাপতি পদে ছিলেন প্রয়াত প্রনব মুখার্জী। তিনি সে সময় ঘটনার সি বি আই তদন্তের দাবি জানালেও বাম সরকার সেই এখনকার রাজ্যসরকারের মত রাজ্যের পুলিশের উপর আস্থা রেখেছিল।এই ঘটনা সে সময়ের সংবাদপত্রে রোজ শীরোনামে ছিল দলগাও এর এই ঘটনা। অথচ দীর্ঘ এক দশকেরও বেশি সময় পর রামপুরহাটের বগটুই কান্ড নিয়ে বিভিন্ন সংবাদ মধ্যম তাদের প্রতিবেদনে বগটুইয়ের গনহত্যা নিয়ে নন্দীগ্রাম, সুচপুর, নেতাই এর উল্লেখ করলেও উত্তরবংগের দলগাও চা বাগানের এই হত্যালীলার ঘটনার তুলনা টানায় সংবাদ জগতও নিয়েও উত্তরবংগের মানুষের মনে রীতিমত ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। সংবাদ মধ্যম সেই ঘটনা প্রসংগ উল্লেখ না করার ক্ষোভের কারন যে অমুলক নয় তার ও একটা বিশেষ কারন রয়েছে। কেননা এতদিন পর খবরটি সামনে এলে সবাই জানতে পারত ওই গনহত্যা কান্ডে নিহত মানুষজনের নিরীহ পরিবার গুলি কোনরুপ সরকারি ক্ষতিপুরন তো দুরের কথা বিচার পর্ব এখনও শেষ না হওয়ায় দোষীরা শাস্তি না পাওয়ায় এখন ও ভয়ে রয়েছে। অভিযুক্ত যে কজন বেচে আছে তারা জামিনে রয়েছে। পাশাপাশি দিন আনা দিন খাওয়া পরিবারগুলি কোনরকমে পরিবার পরিজন নিয়ে দারিদ্রতায় দিন গুজরান করে চলেছে। একজনের পরিবার পয়সা খরচ করে পরিবারের কর্তার ডেথ সার্টিফিকেট যোগাড় করতে সক্ষম হলেও বাকিরা তাও পায়নি বলে অভিযোগ। কি হয়েছিল অভিশপ্ত ২০০৩ সালের ৬ নভেম্বরের সকালে আলিপুরদুয়ারের দলগাও চা বাগানে। বামফ্রন্টের রাজত্ব তাই স্বাভাবিক ভাবে চা বাগানের শ্রমিক নিয়োগ থেকে চা বাগানের বিভিন্ন নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে নাক গলাতো সে সময়ের ওই এলাকার দোর্দান্দপ্রতাপ সিটু নেতা তারকেশ্বর লোহার। আদপে চা বাগানের পাহারাদার হিসেবে চৌকিদারের চাকরিতে কাজে নিযুক্ত থাকলেও সে সময়ে যা হতো বাম ফ্রন্টের নেতা হলে কাজ না করলেও কেউ কিছু বলার ছিল না তাকে। বলতে গেলে ধরা ছোয়ার বাইরে। স্বাভাবিক ভাবে তার দলবলও ছিল ভারি। কালী পুজোর আগে বাগানে তিনজন কেরানী নিয়োগকে ঘিরে গোলমালের সুচনা।স্থানিওদের অভিযোগ মালিক পক্ষের উপর রীতিমতো চাপ সৃষ্টি করে তিনজন বহিরাগত ও নিজের পছন্দের তিন জন বহিরাগতকে তারকেশ্বর নিয়োগপত্র দিতে বাধ্য করেছিলেন বাগান কর্তিপক্ষকে । আর বাগান শ্রমিকদের দাবি ছিল, বহিরাগত নয়, বাগানের শিক্ষিত বেকার যুবকদেরকেই ওই পদ গুলিতে কাজ দিতে হবে। এই ঝামেলাকে ঘিরেই ধিকিধিকি আগুন জ্বলতে শুরু করে দলগাঁওয়ের চা শ্রমিক বস্তিতে । যা তীব্র আকার নেয় ২০০৩ সালের ৬ নভেম্বর সকালে।সে সময় পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য বাগানের ধোবি লাইনের একটি বাড়িতে স্থানিওদের বিক্ষোভকে শায়েস্তা করার ব্যাপারে মতলব আঁটছিলেন তারকেশ্বর লোহার।সঙ্গে ছিল তাঁর কুড়ি জন সাকরেদ।আচমকাই এলাকার হাজার হাজার চা শ্রমিকের রোস গিয়ে পড়ে ওই বাড়ির উপর। মুহমুহ বোমাবাজি দিয়ে শুরু হয় তান্ডব। স্থানিওদের অভিযোগ আত্মরক্ষার স্বার্থে সেই সময় গুলি পর্যন্ত চালিয়েছিল তারকেশ্বর লোহার । তাতেই আগুনে ঘি পড়ে।মুহূর্তেই টাঙ্গি, বল্লম ও তরোয়াল নিয়ে নৃসংশ ভাবে খুন করা হয় তারকেশ্বর লোহারের ১৯ জন সাকরেদকে। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে ঝামেলা চলাকালীন ফাঁক গলে বেঁচে যান স্বয়ং তারকেশ্বর ও তাঁর এক অনুগামী রবি কুজুর।চোখের নিমেষে ১৯ জনকে খালাস করে দেওয়ার পর প্রমাণ লোপাটের জন্যে তারকেশ্বরের ওই বাড়িতেই মৃতদেহ গুলি ঢুকিয়ে দিয়ে পেট্রোল ঢেলে জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন উন্মত্ত চা শ্রমিকরা।ঘটনার খবর পেয়ে পুলিশ ও দমকল বাহিনী যখন পৌঁছোয়, ততক্ষণে সব শেষ হয়ে যায়।শুরু হয় ধরপাকড়।ওই ভয়ঙ্কর হত্যালীলার অপরাধে মোট ১২১ জনের নামে স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে মামলা রুজু করে পুলিশ।গ্রেপ্তার করা হয় তারকেশ্বর লোহার ও রবি কুজুরকেও।মৃতদেহ গুলি পুড়ে এতটাই বিকৃত হয়ে গিয়েছিল যে, ডিএনএ পরীক্ষাতেও ওই দেহ গুলির কোনো পরিচয় মেলেনি।চলতে থাকে মামলা।ইতিমধ্যেই ২১ অভিযুক্তের মৃত্যু হয়েছে।কেটে গিয়েছে টানা ১৯ টা বছর।আজও মৃতদের পরিবার গুলি কোনো ইনসাফ পায়নি বলে অভিযোগ, পায়নি কোনো রকম আর্থিক ক্ষতিপূরণ। তারকেশ্বর লোহার মারা গেলেও এখন ও বেচে আছে তার সাথে পালিয়ে বাচা রবি কুজুর ( নিল জামা) এখন বহাল তবিয়তে বেচে থাকলেও বগটুই হত্যাকান্ড সামনে আসতেই ফের একবার তার সেদিনের বিভৎস্যতার স্মৃতি সমানে তাড়া করে ফিরছে। না পারছেন খেতে না পারছেন ঘুমাতে।বার বার বলছেন এমন ঘটনা যেন আর না ঘটে।কিন্তু রবি কুজুর বা হত্যালীলায় প্রানযাওয়া পরিবারের লোকজনরা এমন কান্ড আর না ঘটুক তা চাইলেও। আজও সভ্য সমাজে সেই ট্রাডিশন চলছেই । বছর ঘুড়ে যায় আসে নতুন সকাল কিন্তু এখনও দেখা মিলল না দগদগের সেই হত্যাকান্ডের সুবিচার। ভুক্তভোগী পরিবার গুলি এখনও দোষীদের শাস্তির দিকে চেয়ে বসে থাকলেও বিচারের বানী সেই নিভৃতে নিরবে ই রয়ে গেছে। মেলেনি কোন ক্ষতিপুরন তাই দিন কাটছে দারিদ্রতায়।